জনস্বাস্থ্য
ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার নেপথ্যে
এ দেশে ২০০০ সালে প্রথম শনাক্ত হওয়া ডেঙ্গু কয়েক বছর আগেও ছিল প্রধানত ঢাকায় সীমাবদ্ধ। এখন প্রায় পুরো দেশেই তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশার ঘনত্ব, প্রজননস্থল, পুরোনো চার সেরো টাইপের সঙ্গে এবার নতুন মিউটেশনের আশঙ্কা এবং ডেঙ্গু-আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও নতুন উপসর্গ– সব প্যারামিটারেই এ বছর ডেঙ্গুর ভয়ানক রূপ দেখা যাচ্ছে। সরকারি হিসাবে গত বছর দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রেকর্ড সংখ্যক ২৮১ জন মারা গিয়েছিলেন। এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি গত বছরের চেয়েও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতির মূলত অবনতি ঘটেছিল অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে। এ বছর জুলাইয়ের শুরুতেই এটি চূড়ায় পৌঁছে গেছে। যদি জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ প্রাদুর্ভাব এবারও অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত চলমান থাকে, তাহলে এটিকে সামাল দিতে বেশ হিমশিম খেতে হবে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সারা বছর ধরে যে ধরনের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না বলেই ডেঙ্গু পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটছে। উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ধারাবাহিক ব্যর্থতায় ডেঙ্গু ঢাকা শহরেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সব শেষ লোক দেখানো ড্রোনের মাধ্যমে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র এবং লার্ভা খোঁজার ফুটেজ কী অর্জন বয়ে এনেছে, তা কেউ জানে না।
২০১৯ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত্ববিদ বি এন নাগপাল ঢাকায় এসে বলে গিয়েছিলেন, নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলো এডিস মশার অন্যতম বড় উৎস। এখানকার মশা উৎপাদনক্ষেত্র বিনাশ করা সম্ভব হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। পরিত্যক্ত টায়ার কিংবা নির্মাণ প্রকল্পে যেন এডিস মশা জন্মাতে না পারে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু সিটি করপোরেশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের। এমনকি ব্যক্তিমালিকানাধীন হাউজিং প্রপার্টির ভেতরে জমে থাকা পানি পরিষ্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ও ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করা এবং বাধ্য করার দায়িত্বও জনগণের করের টাকায় চলা সিটি করপোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের।
ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া দিয়ে ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়া ডেঙ্গুর প্রকোপ ৭০ শতাংশ কমিয়েছে। এ পরিকল্পনায় অত্যধিক সাফল্য পেয়েছে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড অঙ্গরাজ্য। সময় ও খরচসাপেক্ষ এবং অতিমাত্রায় ঘনবসতি হওয়ায় এখনই বাংলাদেশে এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা বরং কলকাতা, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মডেল অনুসরণ করতে পারি। এ ক্ষেত্রে কলকাতা ও মালয়েশিয়ার মডেলটি কাছাকাছি।
কলকাতা ও মালয়েশিয়া উভয় জায়গাতেই আমরা লক্ষ্য করেছি তারা প্রতিরোধ ব্যবস্থায় অত্যধিক জোর দিয়েছে। একটি র্যাপিড অ্যাকশন টিম গঠন করেছে, যাদের মধ্যে আবার ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। একেক গ্রুপের কাজের ধরনও ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে মৌসুমের শুরুতেই গ্রুপগুলো তৎপর হয়ে যায়। তাদের কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো জনসম্পৃক্ততা। ব্যক্তি, সমাজের নেতা এবং বিভিন্ন সংস্থার সক্রিয় অংশগ্রহণ তাদের মডেলে জড়িত। এ দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি ও মশার সম্ভাব্য প্রজনন স্থানগুলো চিহ্নিত করার জন্য জনগণকে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। উপরন্তু মালয়েশিয়ান মডেল শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থার ওপর জোর দেয়; যা প্রাদুর্ভাবের প্রাথমিক শনাক্তকরণ ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ ছাড়া তাদের একটি টিম কোনো রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেই সিটি করপোরেশনকে অবহিত করে। সিটি করপোরেশন তারপর ওই আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়ির আশপাশে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত ওষুধের মাধ্যমে সব মশার প্রজনন ও লার্ভা ধ্বংস করে। এমন মডেলেই মালয়েশিয়া মাত্র কয়েক বছরে তাদের ডেঙ্গুর প্রকোপ ৬০ শতাংশ কমিয়েছে এবং এ মডেল ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। কলকাতাতেও প্রায় একই ধরনের মডেল অনুসরণ করে কার্যকরী ফল পাওয়া গেছে।
সিঙ্গাপুরে দেশটির ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির (এনইএ) কর্মীরা নিয়মিত ঘরে ঘরে, পাবলিক স্পেসে ডেঙ্গু মশার জন্মস্থল খুঁজে ধ্বংস করে। সিঙ্গাপুরের আইন অনুসারে নির্মাণকাজের সময় পেস্ট কন্ট্রোল অফিসার ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দিতে হয়, যাদের কাজ প্রতিদিন সকালে মেঝে পরিষ্কার করা এবং দুই সপ্তাহে একবার মশকরোধী তেল প্রয়োগ করা যেন এসব সাইটে জমা পানিতে মশা জন্মাতে না পারে। বায়ু চলাচল বন্ধ হয়ে মশার লার্ভা মারা যায়। এসবের তদারকিও চলে নিয়মিত।
ডেঙ্গু উপদ্রুত এলাকাগুলোকে ‘ডেঙ্গু ক্লাস্টার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় সেখানে। কোনো আবাসিক এলাকায় ১৪ দিনের মধ্যে ১৫০ মিটার এলাকায় দুই বা ততোধিক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেলে সেটিকে ‘ডেঙ্গু ক্লাস্টার’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১০-এর কম হলে হলুদ, বেশি হলে লাল ব্যানার টানিয়ে সংস্থার ওয়েবসাইটে এলাকাগুলোর পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেওয়া হয়। সিঙ্গাপুরজুড়ে ৭০ হাজার গ্রেভিট্র্যাপ (ডিম পাড়তে ইচ্ছুক স্ত্রী এডিস মশা আটকানোর বিশেষ ফাঁদ) স্থাপন করেছে সরকার। ফাঁদের মধ্যে আটক মশার তথ্য থেকে এনইএ ধারণা করতে পারে কোন এলাকায় এডিস মশার প্রাদুর্ভাব বেশি হচ্ছে। ফলে সীমিতসংখ্যক লোকবল দিয়ে অভিযান পরিচালনা করেও কার্যকর ফল পাওয়া যাচ্ছে। অদৃশ্য করোনাভাইরাসে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক কম হলেও দুঃখজনকভাবে আমরা দৃশ্যমান মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। চোখের সামনে এটি নিয়ন্ত্রণের ভূরি ভূরি উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও আমাদের এ ব্যর্থতার জন্য মূলত দায়ী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হলে এখনও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
রাকিব আল হাসান: চিকিৎসক ও অ্যাক্টিভিস্ট